ভারতে ইসরাইলি নারীকে ধর্ষণের পর আতঙ্ক হাম্পি ছাড়ছেন বিদেশী পর্যটকরা

স্টার গেজিং বা রাতের আকাশে তারা দেখার জন্য বেরিয়েছিলেন কয়েকজন মিলে। ভালোই চলছিল সব কিছু। গিটার বাজিয়ে গান গেয়ে রাতের পরিবেশ উপভোগ করছিলেন তারা। হঠাৎ করে মোটরসাইকেলে করে আসা তিন আগন্তুকের কারণে পাল্টে যায় সব কিছু্। প্রথমে তর্ক, একপর্যায়ে হামলা, ইসরাইলি এক পর্যটকসহ দুই নারীকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় যেমন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, একইসাথে আবারো প্রশ্নের মুখে পড়েছে ভারতে বিদেশী ভ্রমণপিপাসুদের নিরাপত্তা।
ঘটনাটা ঘটেছে ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের হাম্পি শহরের কাছে অবস্থিত সানাপুর লেক এলাকায়। গত কয়েক দিনে বহু বিদেশী পর্যটক ইউনেস্কোর ওই ঐতিহ্যবাহী স্থান ছেড়ে চলে গেছেন বলেও সংবাদ মাধ্যমে খবর এসেছে।
অনেক বিদেশী পর্যটক বুকিং ক্যান্সেল করেছেন। অনেকে আবার তাদের পূর্ববর্তী ভ্রমণ পরিকল্পনা পরিবর্তন করে অন্যত্র যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার রাতে যাদের সাথে এই ঘটনা ঘটে তাদের মধ্যে ছিলেন স্থানীয় হোমস্টে অপারেটর হিসেবে কর্মরত একজন নারী, ইসরাইলি একজন নারী, এক মার্কিন নাগরিক, মহারাষ্ট্রের একজন বাসিন্দা ও উড়িষ্যার এক যুবক।
কোপ্পালের পুলিশ সুপার রাম আরাসিদ্দি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, সানাপুরের কাছে ৬ মার্চ পাঁচজনের ওপর হামলা চালানো হয়। এর মধ্যে দু’জন বিদেশী পর্যটক।
‘হামলাকারীরা পুরুষদের মারধর করে এবং দুই নারীর ওপর যৌন নির্যাতন চালায়। ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে হত্যার চেষ্টা, চুরি ও ধর্ষণের মামলা রুজু করা হয়েছে।’
পুলিশ জানিয়েছে, ওই মার্কিন যুবক এবং মহারাষ্ট্র থেকে আসা অন্য এক পর্যটক যাদের খালে ঠেলে ফেলে দেয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ, তারা সুস্থ আছেন। পরে যে পর্যটকের লাশ উদ্ধার হয়, তিনি উড়িষ্যার বাসিন্দা।
মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট জানিয়েছে, মার্কিন নাগরিকের ওপর এই হামলার ঘটনার বিষয়ে তারা অবগত।
এই ঘটনায় সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে কর্ণাটক পুলিশ দুই ব্যক্তিকে আগেই গ্রেফতার করেছিল। পরে, ঘটনার সাথে যুক্ত সন্দেহে আরো এক যুবককে সোমবার গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
এই ঘটনায় কোপ্পালের পুলিশ সুপারের কাছে রিপোর্ট তলব করেছে কর্ণাটকের রাজ্য মহিলা কমিশন।
কী ঘটেছিল?
ঘটনাটি ৬ মার্চ রাতে কর্ণাটকের হাম্পি হেরিটেজ সাইট থেকে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দূরে সানাপুর গ্রামের কাছে ঘটে। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজধানী হাম্পি বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থানের অন্তর্ভুক্ত।
অসংখ্য পর্যটক বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই ঐতিহ্যবাহী স্থল পরিদর্শনে আসেন।
বিদেশী পর্যটকদের মধ্যে একটা বড় অংশ আসেন ইসরাইল ও ইউরোপ থেকে।
স্থানীয় সূত্রের খবর, এই পর্যটকদের বড় অংশই মূলত সানাপুরে থাকেন, যেখানে প্রাচীন স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ এবং একটি বিখ্যাত হিন্দু মন্দিরও রয়েছে।
ধর্ষণের শিকার দুই নারীর মধ্যে একজনের বয়স ২৯ বছর, তিনি হোমস্টে অপারেটর হিসেবে কর্মরত। ওই রাতে তিনজন পুরুষ পর্যটক ও এক ইসরাইলি নারী পর্যটককে সাথে নিয়ে সানাপুর লেকের কাছে অবস্থিত তুঙ্গভদ্রা রিভার ক্যানেলে গিয়েছিলেন তিনি। উদ্দেশ্য ছিল, রাতের আকাশে নক্ষত্র দেখা।
পুলিশ জানিয়েছে, ‘স্টার গেজিং’ বা আকাশে নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ নিয়ে পর্যটকদের মধ্যে আকর্ষণ বাড়ছে। ওই অঞ্চলের বহু হোমস্টে এবং রিসোর্ট বিদেশী পর্যটকদের স্টার গেজিংয়ের জন্য ব্যবস্থা করে দেয়ার প্রতিশ্রুতিও দেয়।
পুলিশের তদন্তে জানা গেছে, রাত সাড়ে ১০টার দিকে তিনজন ব্যক্তি মোটরসাইকেলে করে এই দলটির কাছে জানতে চান কাছাকাছি কোথায় পেট্রোল পাওয়া যাবে।
হোমস্টে অপারেটর ওই নারী তাদের জানান, কাছাকাছি কোনো গ্যাস স্টেশন নেই। তাদের তারা সানাপুরে খোঁজ নেয়ার পরামর্শও দেন। তখন আচমকাই আগতদের মধ্যে একজন তাদের কাছে ১০০ টাকা দাবি করেন বলে অভিযোগ।
ওই নারী বার্তা সংস্থা এএনআইকে বলেন, ‘আমি তাদের জানাই যে আমার কাছে কোনো টাকা নেই। কিন্তু তারা ক্রমাগত জোর করতে থাকায় আমাদের দলের এক পুরুষ পর্যটক তাদের ২০ টাকা দেন।’
কিন্তু ওই তিনজন ব্যক্তি আরো টাকা দাবি করতে থাকেন। দাবি অনুযায়ী টাকা না মেলায় তারা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ক্রমে দুই পক্ষের মধ্যে তর্কাতর্কি শুরু হয়ে যায়।
হোমস্টে অপারেটর ওই নারী আরো জানিয়েছেন, পাথর হাতে নিয়ে তাদের আঘাত করার হুমকি দিতে থাকে ওই তিন যুবক। পরিস্থিতি আরো বিরূপ আকার নেয়।
তারা দুই নারীকে ধর্ষণ ও মারধর করে। অভিযোগকারী নারী পুলিশকে জানিয়েছেন, এ সময় পুরুষ পর্যটকদের খালে ঠেলে ফেলে দেয়া হয়। তাকে পাথর দিয়ে আঘাত করা হয় এবং ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়া হয়।
অভিযুক্তরা দুটি মোবাইল ফোন এবং নগদ নয় হাজার ৫০০ টাকাও নিয়ে নেয় বলে পুলিশে অভিযোগ জানিয়েছেন তিনি।
এরপর ইসরাইলি নারী পর্যটককেও জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
ভারতীয় ওই নারী বলেন, ‘আমরা চিৎকার করছিলাম, কান্নাকাটি করছিলাম। ওই তিনজন মোটরসাইকেলে চেপে পালিয়ে যায়।’
এরপর পুলিশ তদন্ত শুরু করে এবং তিনজনকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে।
আতঙ্কের ছায়া
ঘটনার পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিরাপত্তার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে পুলিশি টহলও। কিন্তু তা সত্ত্বেও, পর্যটকদের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
কর্ণাটক ট্যুরিস্ট গাইডস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক বিরুপাক্ষ ভি হাম্পি বিবিসিকে বলেছেন, ‘প্রতি বছর সব মিলিয়ে প্রতি এক লাখ বা তারও বেশি বিদেশী পর্যটক এই এলাকায় বেড়াতে আসেন। তবে হামলার খবর প্রকাশ্যে আসার পর থেকে বেশিভাগ দর্শনার্থী হয় বুকিং বাতিল করেছেন অথবা এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন।’
একই কথা জানিয়েছেন ওই অঞ্চলে ট্যুর গাইড হিসেবে কর্মরত সৈয়দ ইসমাইল। তিনি বিবিসি হিন্দিকে বলেন, ‘প্রায় ৯০ শতাংশ পর্যটক যাদের অধিকাংশই ইসরাইলের নাগরিক, বৃহস্পতিবারের ঘটনার পর ওই এলাকার হোমস্টে ছেড়ে চলে গেছেন।’
ইসমাইল আরো বলেন, যারা এখনো রয়ে গেছেন, তাদের দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করতে এবং খুব দূরে না যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
পর্যটকদের কেউ কেউ জানিয়েছেন, ভ্রমণ পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছে তারা।
তালিয়া জিলবার নামে ইসরাইলি পর্যটক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছেন, ‘এই ঘটনাটি সত্যিই ভয়ের এবং আমরা আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। হোলি উৎসব পর্যন্ত আমাদের এখানে থাকার পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু এখন আমরা রাজস্থান চলে যাচ্ছি।’
বছর ২১-এর ওই তরুণী তার পাঁচ বন্ধুর সাথে হাম্পি ভ্রমণের উদ্দেশে এসেছিলেন। রোববার তারা ওই এলাকা ছেড়ে চলে যান।
মুখ্যমন্ত্রী কী বলেছেন?
কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে পর্যটকদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটারে) হ্যান্ডেলে তিনি লিখেছেন, ‘কোপ্পাল জেলার গঙ্গাবতী তালুকের সানাপুরে এক ইসরাইলি নাগরিক এবং হোমস্টে অপারেটরের ওপর হামলা ও ধর্ষণ একটি জঘন্য অপরাধ।’
‘ঘটনাটি জানা মাত্রই আমি সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের তদন্ত করে দোষীদের দ্রুত গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছি।’
এরপর পর্যটকদের আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘পর্যটকসহ আমাদের রাজ্যে আসা প্রতিটি মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
কংগ্রেসের সাংসদ জিসি চন্দ্রশেখর এই ঘটনাকে দুর্ভাগ্যজনক আখ্যা দিয়ে নিন্দা করেছেন।
কর্ণাটকের মন্ত্রী শিবরাজ টাঙ্গাদাগি পর্যটকদের গভীর রাতে ভ্রমণ না করার পরামর্শ দিয়েছেন।
পুলিশি তৎপরতা
এই ঘটনার পর ওই এলাকাসহ আশপাশের সমস্ত পর্যটকস্থল এবং হোটেলে কড়া নজরদারি শুরু করেছে পুলিশ প্রশাসন। রাতে পুলিশি টহল বাড়ানো হয়েছে।
সোমবার সানাপুর, আনেগুণ্ডি, বাসপুরা, বাসপুর অঞ্চলের হোমস্টে এবং হোটেল পরিদর্শন করেন কোপ্পালের পুলিশ সুপার রাম আরাসিদ্দি। হোটেলে উপস্থিত সমস্ত আবাসিকদের বিষয়ে খোঁজ খবর নেয়া হয়।
পুলিশের ওই কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এএনআইকে বলেছেন, ‘গুরুত্ব সহকারে টহল দেয়া হচ্ছে, নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। এই সমস্ত এলাকাও পরিদর্শন করছি আমরা।’
‘রিসোর্টগুলোতে রাতেও আমরা চেক করছি।’
পুলিশ জানিয়েছে, ওই এলাকায় মাদকের ব্যবহার রুখতে কড়া পদক্ষেপও নেয়া হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, এর আগেও ভারতে বিদেশী পর্যটকদের নিরাপত্তা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উঠেছে। গত বছর ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ঝাড়খণ্ডে ব্রাজিল-স্প্যানিশ দ্বৈত নাগরিক এক নারী পর্যটককে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল। তার স্বামীকেও মারধর এবং হেনস্থা করারো অভিযোগ ছিল।
এর আগে, ২০১৭ সালে এক বিদেশী তরুণী পর্যটককে গোয়ায় ধর্ষণ ও খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তোলপাড় হয়েছিল গোটা দেশ। ওই ঘটনায় গেফতার ব্যক্তিকে সম্প্রতি দোষী সাব্যস্ত করেছে আদালত।
সূত্র : বিবিসি
Related News

ভারতে ইসরাইলি নারীকে ধর্ষণের পর আতঙ্ক হাম্পি ছাড়ছেন বিদেশী পর্যটকরা
স্টার গেজিং বা রাতের আকাশে তারা দেখার জন্য বেরিয়েছিলেন কয়েকজন মিলে। ভালোই চলছিল সব কিছু।Read More

যুদ্ধবিরতি আলোচনায় কাতারে প্রতিনিধিদল পাঠাতে সম্মত ইসরাইল
গাজা-ইসরাইল যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের মেয়াদ ১ মার্চ। দ্বিতীয় ধাপের আলোচনার জন্য কাতাতে প্রতিনিধিদল পাঠাবে ইসরাইল।Read More