Main Menu

আফজালাবাদ-দক্ষিণ খুরমা-শান্তিগঞ্জ হয়ে সুনামগঞ্জ জেলা সদরে যাবে রেললাইন

সুনামগঞ্জের কোন এলাকা দিয়ে রেললাইন যাবে- তা নিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের ভিন্নমত প্রকল্পটিকে রাজনৈতিক রূপ দেয়। সুনামগঞ্জের পাঁচ এমপির সঙ্গে একমত হয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রুট নির্দিষ্ট করে রেললাইন নির্মাণের দাবি জানিয়ে রেলমন্ত্রীকে ডিও লেটার দিয়েছিলেন। কিন্তু সেদিক দিয়ে রেলপথ না হয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী যে অ্যালাইনমেন্টের পক্ষে মত দিয়েছিলেন, সে এলাকা দিয়েই হবে রেলপথ। প্রাথমিকভাবে চূড়ান্ত হয়েছে আফজালাবাদ-দক্ষিণ খুরমা-শান্তিগঞ্জ হয়ে সুনামগঞ্জ জেলা সদরে যাবে রেললাইন।
এরই মধ্যে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা যাচাই করে এই রুটে ৪৪ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের সুপারিশ করেছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। গত ৭ জানুয়ারি রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সভায় ওই রুট রেলপথ নির্মাণে সবচেয়ে উপযোগী বলে সিদ্ধান্ত হয়। গত ১৯ জানুয়ারি রেল মন্ত্রণালয়ের সভায় এ রুটের পক্ষে মতামত দেওয়া হয়েছে। সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্পের পরিচালক মহিউদ্দিন আরিফ সমকালকে বলেছেন, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান জরিপ করে বলেছে, আফজালাবাদ-দক্ষিণ খুরমা-শান্তিগঞ্জ-সুনামগঞ্জ রুটই রেলপথ নির্মাণের জন্য সবচেয়ে ভালো। এ রুট চূড়ান্ত করতে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। মন্ত্রাণলয় অনুমোদন দিলে রুট চূড়ান্ত হবে।
৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘সুনামগঞ্জ জেলা সদরে রেলওয়ে সংযোগের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও বিশদ নকশা প্রণয়ন’ প্রকল্পে কাজ শুরু হয়। বাংলাদেশের মজুমদার এন্টারপ্রাইজ এবং চীনের সিএইচইসি যৌথভাবে এ কাজ করছে। গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ২৯ শতাংশ। আগামী জুনের মধ্যে কাজ হওয়ার কথা থাকলেও অগ্রগতি প্রতিবেদন বলছে, তা সম্ভব নয়। প্রকল্প পরিচালক বলেছেন, বর্ষা ও করোনার কারণে কাঙ্ক্ষিত গতিতে কাজ হয়নি।
সুনামগঞ্জ রেল সংযোগ প্রকল্পের আরেক বাধা ছিল রাজনৈতিক। গত বছরের ১৪ জুন জেলার সুনামগঞ্জের এমপি জয়া সেনগুপ্তা, মহিবুর রহমান মানিক, পীর ফজলুর রহমান, মোয়াজ্জেম হোসেন রতন এবং সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি শামীমা আক্তার খানম রেলমন্ত্রীকে ডিও লেটার দিয়ে ছাতক থেকে দোয়ারাবাজার-সুনামগঞ্জ হয়ে মোহনগঞ্জ রেলপথ নির্মাণের দাবি জানান। এমপিরা চিঠিতে বলেন, দোয়ারাবাজার হয়ে গেলে মাত্র ২৭-২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করতে হবে। পরিকল্পনামন্ত্রীর এলাকা হয়ে গেলে প্রায় ৫০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করতে হবে।
এমপিদের সমর্থনে ১৮ জুন রেলমন্ত্রীকে ডিও লেটার দেন সিলেট-১ আসনের এমপি আব্দুল মোমেন। বাকি পাঁচ এমপিকে ডিও লেটারের অনুলিপি দিলেও সুনামগঞ্জ-৩ (শান্তিগঞ্জ-জগন্নাথপুর) আসনের এমপি পরিকল্পনামন্ত্রীকে তা দেননি পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
এ নিয়ে দুই মন্ত্রী ফেসবুকে পাল্টাপাল্টি স্ট্যাটাস দেন। পরিকল্পনামন্ত্রী তখন লিখেছিলেন, ‘জাতীয় পার্টির একজনসহ সুনামগঞ্জের মোট পাঁচজন এমপিকে সমর্থন করে রেলমন্ত্রীর কাছে তিনি (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) যে ডিও দিয়েছেন, তা আমাকে বিস্মিত করেছে। তিনি খুব ভালো করে জানেন, আমি সুনামগঞ্জের সংসদ সদস্য। সুনামগঞ্জের সঙ্গে রেল যোগাযোগের বিষয়টি আমারও বিষয়। এ বিষয়ে আমি তার চেয়ে ভালো করে জানি।’
দুই মন্ত্রীর বাহাসকে সিলেটের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন হিসেবে দেখা হয়। প্রকল্প পরিচালক বলেছেন, দুই মন্ত্রী কী বলেছেন- তা নিয়ে তিনি মন্তব্য করতে চান না। যেদিক দিয়ে রেলপথ নির্মাণ করলে ভালো হবে, সেই রুটই সুপারিশ করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ-৫ আসনের এমপি মুহিবুর রহমান মানিক বলছেন, ছাতক থেকে দোয়ারাবাজারের শিবগঞ্জ-শ্রীপুর-বেতগঞ্জ হয়ে মোহনগঞ্জ পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণে আগেই সমীক্ষা হয়েছে। আফজালাবাদ থেকে রেললাইন হলে তা হবে জনমতের বিপক্ষে। ওই রুট মানুষের কাজে আসবে না। পরিকল্পনামন্ত্রী সারাজীবন সরকারি চাকরি করেছেন, তার হয়তো এলাকার ভৌগোলিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা নেই।
দোয়ারাবাজার হয়ে রেলপথ হলে হাওরের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে- এ যুক্তির বিরোধিতা করে মুহিবুর রহমান মানিক বলেছেন, তাহলে তো হাওরের উন্নয়নই করা যাবে না। ছাতক অর্থনৈতিক অঞ্চল। তা বাদ দিয়ে ১৫ কিলোমিটার দূরের আফজালাবাদ দিয়ে রেলপথ হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের কোনো কাজে আসবে না। সেদিক দিয়ে সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়ক রয়েছে। পাশ দিয়ে আরেকটি রেললাইন করার কী যুক্তি থাকতে পারে? মুহিবুর রহমানের দাবি, পরিকল্পনামন্ত্রী নিজ নির্বাচনী এলাকা দিয়ে রেললাইন নিতে চান। সুনামগঞ্জের মানুষ তা মানবে না।
সিলেট থেকে ছাতক পর্যন্ত রেলপথ নির্মিত হয় ১৯৫৪ সালে। ছাতক থেকে আফজালাবাদ পর্যন্ত রেললাইন রয়েছে। ছাতক থেকে দোয়ারাবাজার হয়ে সুনামগঞ্জ রুট হলে ২৭-২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করতে হতো। তা বাদ দিয়ে আফজালাবাদ স্টেশন থেকে দক্ষিণ খুরমা, পরিকল্পনামন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা শান্তিগঞ্জ হয়ে রেলপথ নির্মাণ সুপারিশের প্রসঙ্গে মহিউদ্দিন আরিফ বলেছেন, দোয়ারাবাজার হয়ে দূরত্ব কম হলেও পুরো পথ হাওরের মধ্য দিয়ে। উড়াল রেলপথ নির্মাণ করলে নির্মাণ ব্যয় অনেক বেশি হবে। জলাভূমিতে নির্মাণকাজ জটিল ও সময়সাপেক্ষ। হাওরের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট হবে। দক্ষিণ খুরমা, শান্তিবাগ হয়ে রেলপথ নির্মাণের যে অ্যালাইনমেন্ট সুপারিশ করা হয়েছে, তার দৈর্ঘ্যে বেশি হলেও নির্মাণ জটিলতা কম; মাত্র দুই কিলোমিটার রেলপথ জালিয়ার হাওর দিয়ে যাবে। বাকি পথ বিদ্যমান সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়কের পাশ দিয়ে যাবে।
অ্যালাইনমেন্ট চূড়ান্ত করার পর বিশদ নকশা প্রণয়নে সাব-সয়েল, টপসয়েল, টপোগ্রাফিক ও হাইড্রোলজিক্যাল সমীক্ষা করতে হবে। প্রকল্পের কাজ জুনে শেষ করার কথা থাকলেও এসব কাজ করতে কত সময় লাগতে পারে- তা নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি প্রকল্প পরিচালক। তিনি জানিয়েছেন, বিস্তারিত সমীক্ষার পর বলা হবে, কত ব্যয় হবে।
২০১৫ সালে ইকোসার্ভ ইঞ্জিনিয়ারিং নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে জরিপ করেছিল রেলওয়ে। তারা ছাতক থেকে দোয়ারাবাজার হয়ে সুনামগঞ্জ শহর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের জন্য তিনটি রুট সুপারিশ করেছিল। এর আগে ২০১৫ সালেও প্রাথমিক সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ হয়েছে।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাঁচটি বিকল্প অ্যালাইনমেন্ট প্রস্তাব করা হয়েছিল। ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটি (পিএসসি) তিনটি রুটে জরিপের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সরেজমিন যাচাইয়ে বিদ্যমান আফজালাবাদ স্টেশন থেকে দক্ষিণ খুরমা, শান্তিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ রুট রেলপথ নির্মাণের জন্য সবচেয়ে উপযোগী বিবেচিত হয়েছে। প্রেজেন্টেশনে বলা হয়েছে, ৪৫ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার অ্যালাইনমেন্টে টপোগ্রাফিক জরিপ হয়েছে। এ রুটে ৬৬টি ছোট-বড় জলাভূমি রয়েছে। দক্ষিণ খুরমা, শান্তিগঞ্জে দুটি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। পথে আরও দুটি স্টেশন তৈরি করতে হবে। ১২৮টি বসতবাড়ি, অবকাঠামো সরাতে হবে রেলপথ নির্মাণে। সাড়ে ১৩ হাজার গাছ কাটা পড়বে। পাঁচটি স্টেশনের জন্য ৫০ একরসহ মোট ৬১৩ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে।
সুত্রঃ সমকাল






Related News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *