Main Menu

আজ ৮৬ ছুঁতেন সত্যজিতের অপু

মাস্ক নেই কেন, কাকু? ‘আমার ৮৫ বছর হয়ে গেল! আমার আর মাস্ক পরে কী হবে? নতুন করে কী আর সচেতন হব? ধুর!’
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অসুস্থ হওয়ার কিছুদিন আগে সত্যজিৎ রায়ের পুত্র সন্দীপ রায়ের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন এটি। নিজের এক লেখায় সেদিনের কথা উল্লেখ করেন সন্দীপ। কিছুদিন পর করোনায় আক্রান্ত হলেন সত্যজিতের ‘অপু’ সৌমিত্র। হাসপাতালের বিছানায় করোনাকে জয় করেছিলেন ঠিকই, হেরে গেলেন অন্য সব শারীরিক জটিলতা আর বয়সের কাছে। ৮৫ বছরের জাগতিক ভ্রমণ শেষ করে গত বছরের ১৫ নভেম্বর যাত্রা করলেন অনন্তকালে।
আজ ১৯ জানুয়ারি সমকালীন বাংলা চলচ্চিত্রের মহাতারকা, অভিনেতা-নাট্যকার-বাচিকশিল্পী-কবি-চিত্রশিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন। বেঁচে থাকলে আজ ৮৬ ছুঁতেন সৌমিত্র। তাঁকে নিয়েই উদ্‌যাপন হতো জন্মদিনের প্রহরগুলো। কিন্তু আজ তাঁর ছবির গলায় মালা থাকবে, প্রদীপ জ্বলবে সামনে। সৌমিত্রকে নিয়ে আবার স্মৃতিচারণা হবে, কথা হবে।

গত বছর ঠিক এই দিনে দুটি চমক নিয়ে উদ্‌যাপন হয়েছিল সৌমিত্রর জন্মদিন। সেদিন রোববার সকালেই তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে বেলাশুরু ছবির ফার্স্ট লুক প্রকাশ্যে এনে চমক দিলেন নির্মাতা জুটি নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। আর বিকেলে অভিনেতা ও পরিচালক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় দিয়েছিলেন আরেক চমক। সৌমিত্রর জন্মদিনেই তাঁর জীবনীভিত্তিক ছবি (বায়োপিক) নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন।

বলেছিলেন, এ বায়োপিকে তরুণ সৌমিত্রর ভূমিকায় অভিনয় করবেন যিশু সেনগুপ্ত। আর পরিণত বা শেষ বয়সের অংশে অভিনয় করবেন স্বয়ং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ‘অভিযান’ নামের সেই বায়োপিকের কাজও করেছেন সৌমিত্র। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হয়েছিল বায়োপিকের শুটিং। বেশ কিছুদিন বিরতির পর ভারতে করোনার মধ্যেই শুটিং চালু হওয়ার পর নির্ভয়ে সেটে ফিরেছিলেন সৌমিত্র। জুলাই মাসেই ‘অভিযান’-এর শুটিং শেষ করেন তিনি। সৌমিত্র অভিনীত শেষ ফিচার ফিল্ম এটি। পরব্রত চট্টোপাধ্যায়ের ইনস্টাগ্রাম সূত্রে জানা গেছে, আজ ‘অভিযান’ ছবির ট্রিজার প্রকাশ করবেন তিনি। ‘অভিযান’ ছাড়াও মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে সৌমিত্রর ‘বেলা শুরু’।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়জীবনের ব্যাপ্তি প্রায় ছয় দশকের। দীর্ঘ ৬০ বছরের ক্যারিয়ারে তিন শতাশিক ছবি। অসংখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তবে বললে অত্যুক্তি হবে না, মানুষ সবচেয়ে বেশি মনে রেখেছে তাঁর অভিনীত প্রথম চরিত্রটিই, অপুর সংসার-এর ‘অপু’কে।

সৌমিত্র নামটি এলে সবার আগে ও সবচেয়ে বেশি আসবে পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের নাম। সত্যজিতের পরিচালনায় ১৫টি ছবিতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র। পরস্পরের বোঝাপড়া ছিল দারুণ। সন্দীপ রায়েরই এক লেখায় জানা যায়, সেই সময়ে অনেকে সত্যজিৎ রায়কে সৌমিত্রর ‘মানসপিতা’ বলতেন আর সৌমিত্রকে সত্যজিতের ‘মানসপুত্র’। পরিচালক ও অভিনেতার নির্ভরতা, রসায়ন দেখে অনেকে বলতেন, দুজনের মধ্যে পিতা-পুত্রের সম্পর্কই হয়ে গেছে।

সৌমিত্র বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বাবা ছেলের সম্পর্ক যেমন ইতিবাচক হয়, মানিকদা আমাকে নিয়ে তেমন ছিলেন।’ সৌমিত্রর মেন্টরের ভূমিকাটা পুরোদস্তুর পালন করেছেন সত্যজিৎ।

১৯৫৬ সালের ছবি অপরাজিত। তার আগেই সৌমিত্রকে দেখেছিলেন সত্যজিৎ। কোথায় হয়েছিল এই জুটির প্রথম দেখা? ‘অপরাজিত’ ছবির সময় অপুর খোঁজ করছিলেন সত্যজিৎ রায়। সেই সময়ই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের এক বন্ধু পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন দুজনের। তবে ‘অপরাজিত’-র অপুর হিসেবে সৌমিত্রর বয়স ও উচ্চতা দুটোই বেশি বলে মনে করেছিলেন সত্যজিৎ।

তখন সৌমিত্র বয়স পেরিয়েছিলেন ২০ বছর। কিন্তু অপরাজিত অপুর কৈশোর। তাই অপেক্ষা করতে হলো তাঁর সংসার শুরু হওয়া অবধি। সৌমিত্র নিজেও জানতেন না কখন তিনি ‘অপু’ হচ্ছেন। একদিন গেলেন জলসাঘর-এর শুটিং দেখতে। সেটেই সৌমিত্রকে ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন পরিচালক সত্যজিৎ। ছবি বিশ্বাসকে বলেছিলেন, ইনি হচ্ছেন অপু, অপুর সংসার-এর অপু।

এ প্রসঙ্গে জীবনকালে ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সৌমিত্র জানিয়েছিলেন, ‘অপরাজিত’ ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবির পুরস্কার পায়। কলকাতায় ফেরার পর এক সংবাদ সম্মেলনে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, প্রাপ্তবয়স্ক অপুর চরিত্র কে করতে পারে, সে কথা তাঁর মাথায় রয়েছে। আমার কোনো ধারণাই ছিল না উনি আমার কথা ভাবছেন।’ ‘অপুর সংসার’-এর কয়েক বছর পর সৌমিত্রকে সত্যজিৎ বলেছিলেন, তাঁদের প্রথমবার দেখা হওয়ার পরই ট্রিলজির কথা ভেবে রেখেছিলেন।

সন্দীপ রায়ের স্মৃতিচারণায় জানা যায়, সৌমিত্র যে সত্যজিতের চলচ্চিত্রে শুধুই অভিনয়শিল্পী ছিলেন তা নয়, রায় পরিবারের সঙ্গে একাত্ম হয়ে থাকতেন। যেখানে আগে-পরে ৬০ বছরের ভ্রমণ। সে সময় শুটিং ইউনিটে মনে হতো, তিনি কেবল অভিনেতা নন। স্পট বয় থেকে ক্যামেরাম্যান, সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, গল্প গল্পে মাতিয়ে রাখতেন শুটিং ফ্লোর। সত্যজিৎ রায়ও আলাদা করে ভাবতেন সৌমিত্রকে নিয়ে। যেমন অপুর সংসার-এর পর সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, ‘আমার এ ছবিতে তোমার কাজ যা হয়েছে, তাতে মানুষ তোমায় কাজ দেবে। তবু যদি কাজ না পাও, আর কিছু না হোক, তুমি আমার সহকারী হয়ে তো কাজ করতেই পারো।’

১৯৭০ সালে সত্যজিৎ-সৌমিত্র যুগলবন্দীর অরণ্যের দিনরাত্রি মুক্তি পায়, যেখানে নতুন করে পাওয়া যায় সৌমিত্রকে। এভাবে নিত্যনতুন ভূমিকায় নিজেকে ভেঙেছেন অশনিসংকেত-এর গঙ্গাচরণ, হীরক রাজা দেশের উদয়ন পণ্ডিত। সেই মানুষটি ৬০ বছরের বেশি কর্মজীবনে অভিনয় করেছেন কয়েক প্রজন্মের পরিচালকদের সঙ্গে। শোনা যায়, তাঁকে ভেবেই অসুখ ছবির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ।

সৃজিত মুখার্জির হেমলক সোসাইটি, অতনু ঘোষের ময়ূরাক্ষী, নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বেলা শেষে বা পোস্ত-তে নিজেকে নানাভাবে প্রমাণ করেছেন সৌমিত্র। তবে সব ছাপিয়ে সত্যজিতের ফ্রেমের জন্যই এসেছিলেন এই সংসারে। করোনার লড়াইয়ে জিতেও শেষ পর্যন্ত জীবনের লড়াইয়ে হার মানা অপু বাঙালি মনে অপরাজিত থাকবেন, দুই বাংলার রুপালি সংসারে তিনি থাকবেন চিরকাল।

সৌজন্যে: প্রথম আলো






Related News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *