সিরাজউদ্দৌলা হয়ে মানুষের হৃদয়ে গেঁথে আছেন তিনি

আনোয়ার হোসেন এদেশের সিনেমায় আজও নবাব সিরাজউদ্দৌলা হয়ে অসংখ্য মানুষের হৃদয়ে গেঁথে আছেন। খান আতা বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাবকে নিয়ে একটি সিনেমা নির্মাণ করেন। তারপর আনোয়ার বনে যান নবাব, বাংলার নবাব। একটিমাত্র কাজ দিয়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করেন। ঘরে ঘরে পরিচিতি লাভ করেন।
তাকে বলা হতো মুকুটহীন নবাব। একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্রে আজীবন সম্মাননা, বাচসাস পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার পেয়েছেন জীবদ্দশায়। নিগার পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি।
টানা পাঁচ দশক তিনি অভিনয় করেছেন ঢাকাই সিনেমায়।
সামাজিক, সাহিত্য নির্ভর, রাজনৈতিক, পোশাকি—সব ঘরানার সিনেমায় এবং যেকোনো চরিত্রে মানিয়ে যেতেন। নায়ক, ভিলেন, বড় ভাই, লাঠিয়াল, বাবা, সবরকম চরিত্রে দেখা গেছে তাকে। চলচ্চিত্র বোদ্ধারা বলতেন, তিনি একজন জাত অভিনেতা। অনেক সিনেমায় আনোয়ার হোসেনের হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়া নিয়ে এখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা হয়।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা দিয়ে ঢাকাই সিনেমার নবাব বনে যান আনোয়ার হোসেন। তারপর যেখানে গিয়েছেন পেয়েছেন নবাব চরিত্রের জন্য বিপুল সম্মান ও ভালোবাসা। যতদিন বেঁচে ছিলেন নবাব হিসেবেই তাকে সবাই ভালোবাসায় সিক্ত করেছেন।
সিনেমায় হার্ট অ্যাটাকে আনোয়ার হোসেনের মারা যাওয়া দৃশ্য।
তবে, নবাব সিরাজউদ্দৌলা করার অনেক আগেই আনোয়ার চলচ্চিত্রে নাম লেখান। ‘তোমার আমার’ সিনেমায় খলনায়ক ছিলেন তিনি। পরিচালনা করেন মহিউদ্দিন। গল্পটা ১৯৬১ সালের। তারপর তিনি নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন সূর্যস্নান সিনেমায়। সূর্যস্নান তার অভিনীত দ্বিতীয় সিনেমা।
উর্দু সিনেমায়ও তিনি অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত সামাজিক সিনেমা মানুষকে কাঁদিয়েছে। প্রতিবাদী চরিত্রে অভিনয় করে মানুষকে সাহসী হওয়ার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। বড় ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করে মানুষকে মমতায় আবদ্ধ করেছেন। সৎ ও পরিশ্রমী বাবার চরিত্রে অভিনয় করে হলভর্তি মানুষের বাহবা পেয়েছেন। গায়েনের চরিত্রে অভিনয় করে খেটে খাওয়া মানুষের হৃদয়ে শক্ত আসন গড়েছেন। আবার পোশাকি সিনেমাও করেছেন। সেখানেও পেয়েছেন সফলতা।
আনোয়ার হোসেনের জীবনের অন্যতম সেরা একটি সিনেমার মধ্যে রয়েছে ‘জীবন থেকে নেয়া’। জহির রায়হান পরিচালিত কালজয়ী এই সিনেমা তাকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। অভিনয় গুণ দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছন এদেশে আনোয়ার হোসেন একজনই। পরিপূর্ণ শিল্পী বলতে যা বোঝায় তিনি তাই ছিলেন।
‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমায় তিনি ছিলেন রাজনৈতিক আন্দোলনের একজন কর্মী। তার একটি সংলাপ ছিল এরকম—সাথী আর বিথীকে ডাক তো। কাল প্রভাত ফেরিতে যেতে হবে না? তারপর তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গান ধরেন—আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি।
‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমায় তার মুখে আরও একটি সংলাপ দর্শকদের দৃষ্টি কাড়ে। সেটি হচ্ছে—দেশকে ভালোবাসতে হয় নিঃস্বার্থভাবে।
এদেশে কালজয়ী সিনেমা নির্মাণে যেসব পরিচালক বড় ভূমিকা রেখেছেন, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন। জনপ্রিয় অভিনেতা থেকে এক সময় বরেণ্য অভিনেতা হয়ে যান।
সামাজিক সিনেমা ‘লাঠিয়াল’ তাকে দিয়েছ অন্যরকম খ্যাতি। পরিচালক ছিলেন নারায়ণ ঘোষ মিতা। কাদের লাঠিয়ালের চরিত্রে অভিনয় করে সেই সময় ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২২ আগস্ট মুক্তি পায় ‘লাঠিয়াল’। এই সিনেমায় অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি।
‘গোলাপি এখন ট্রেনে’ তাকে দিয়েছে সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের প্রবল ভালোবাসা। এই সিনেমার জন্যও তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। বিখ্যাত পরিচালক আমজাদ হোসেন পরিচালিত এই সিনেমায় গায়েনের চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেন। এরপর দ্বিতীয়বার তার ঘরে আসে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এই সিনেমায় তার লিপে একটি গান ছিল, যা আজও মানুষ মনে রেখেছে। গানটি হচ্ছে—আছেন আমার মুক্তার, আছেন আমার বারিস্টার।
‘ভাত দে’ এদেশের একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী সিনেমা। বিশেষ করে সামাজিক সিনেমা হিসেবে। পরিচালনা করেন আমজাদ হোসেন। এই সিনেমায় আনোয়ার হোসেন সাইজুদ্দিন বয়াতি চরিত্রে অভিনয় করেন। কত কাঁদলাম কত গো সাধলাম, আইলা না…গানটি আনোয়ার হোসেনের লিপে ছিল।
‘ভাত দে’ সিনেমার একটি সংলাপ অনেক দর্শককে কাঁদিয়েছে। সংলাপটি হচ্ছে—ভাত দে মা, খিদা লাগছে তো! মা খিদা লাগছে, ভাত দে মা…
‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’ তুমুল জনপ্রিয় একটি গান। আনোয়ার হোসেন অভিনীত ‘বড় ভালো লোক ছিল’ সিনেমার গান এটি। এই গানের সঙ্গে পর্দায় ঠোঁট মেলান আনোয়ার হোসেন।
মুক্তিযুদ্ধের সিনেমাও করেছেন তিনি। তার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে—অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী।
একজীবনে তিনি প্রায় ৩৫০টি সিনেমা করেছেন।
শহরে দর্শক থেকে শুরু করে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে অভিনয়জীবনে পেয়েছেন বিপুল ভালোবাসা। গুণী এই অভিনেতা কলেজ জীবনে আসকার ইবনে শাইখের ‘পদক্ষেপ’ নাটকে অভিনয় করেন। তখন তিনি ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজের ছাত্র ছিলেন।
চলচ্চিত্রের কাছের মানুষেরা তাকে ডাকতেন আনু ভাই বলে। গোলাপি এখন ট্রেনে, লাঠিয়ালসহ কয়েকটি সিনেমায় তার সঙ্গে অভিনয় করেছেন ববিতা। তিনি বলেন, আনু ভাই অনেক বড় মাপের অভিনেতা ছিলেন। তার চোখ মুখ সবই যেন অভিনয় করত। এত পরিপূর্ণ শিল্পী কমই ছিল। তার মতো শিল্পী আর আসবে কি না জানি না। আমাদের সিনেমাকে তিনি সমৃদ্ধ করে গেছেন।
নায়ক সোহেল রানা বলেন, আনোয়ার হোসেন সত্যিকারের শিল্পী ছিলেন। পরিপূর্ণ ও জাত শিল্পী ছিলেন। সোনালি দিনের সিনেমায় তার অবদান অনেক। সবরকম চরিত্রে অভিনয় করার ক্ষমতা সবার থাকে না, তার ছিল।
নায়ক উজ্জ্বল বলেন, অত্যন্ত বিনয়ী ও ভালো একজন মানুষ ছিলেন। চলচ্চিত্র শিল্পে তার অবদান ব্যাপক। সবাই তাকে সম্মান করতেন। দর্শকদের অতি প্রিয় অভিনেতা ছিলেন। অসংখ্য সিনেমা করেছেন তিনি। তার প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা।
গুণী অভিনেতা আনোয়ার হোসেন ২০১৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ৮২ বছর বয়সে মারা যান।
সংগৃহিত
Related News

সিরাজউদ্দৌলা হয়ে মানুষের হৃদয়ে গেঁথে আছেন তিনি
আনোয়ার হোসেন এদেশের সিনেমায় আজও নবাব সিরাজউদ্দৌলা হয়ে অসংখ্য মানুষের হৃদয়ে গেঁথে আছেন। খান আতাRead More

শো নিয়ে ব্যস্ত ন্যান্সি ও তার দল
গান নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন দেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী নাজমুন মুনিরা ন্যান্সি। ক’দিন আগেই মেক্সিকোRead More