Main Menu

আদালতে শাবি ছাত্র বুলবুল হত্যায় ৩ ‘খুনি’র লোমহর্ষক বর্ণনা

গত ২৫ জুলাই নিজ ক্যাম্পাসে খুন হন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থী মো. বুলবুল আহমেদ (২২)। তবে ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় পুলিশ।

হত্যার অভিযোগে যে তিনজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে তাঁরা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্যেই হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে, সেটিও উঠে এসেছে তাদের জবানবন্দিতে।

ঘটনার পরদিন (২৬ জুলাই) মো. আবুল হোসেন (১৯) নামের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরদিন গ্রেপ্তার করা হয় মো. হাসান (১৯) ও কামরুল আহমদ (২৬) নামের আরও দুজনকে। তাঁরা তিনজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী টিলারগাঁও এলাকার বাসিন্দা। তারা তিনজনই পেশায় রাজমিস্ত্রি, তবে সময়-সুযোগ বুঝে ছিনতাইও করে থাকেন তারা।

গ্রেপ্তারের পর তাঁরা তিনজনই সিলেটের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিতীয় আদালতের বিচারক মো. সুমন ভূঁইয়ার কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে গিয়ে কীভাবে বুলবুলকে তাঁরা হত্যা করেন, সেই লোমহর্ষক বর্ণনা দেন তারা আদালতে।

তিন আসামির জবানবন্দি থেকে জানা যায়, ২৫ জুলাই সন্ধ্যায় মো. হাসান মুঠোফোনে কামরুল আহমদকে কল দেন। হাসান মুঠোফোনে কামরুলকে জানান, গাজী-কালুর টিলায় একটি ছেলে (বুলবুল) ও একটি মেয়ে (বুলবুলের বান্ধবী মার্জিয়া উর্মি) বসে কথা বলছেন। মো. আবুল হোসেন তাঁদের নজরদারিতে রেখেছেন। এই ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে জিনিসপত্র ছিনতাই করা যাবে বলে কামরুলকে জানান তিনি। এর ১০ থেকে ১২ মিনিটের মধ্যে টিলায় এসে পৌঁছান কামরুল। এরপর হাসান ও আবুলকে বুলবুল-উর্মির কাছে পাঠান তিনি।

কামরুল তাঁর জবানবন্দিতে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈদ্যুতিক বাতির আবছা আলোয় একপর্যায়ে তিনি দেখেন, হাসান ও আবুল ছেলেটির সঙ্গে ধস্তাধস্তি (মারামারি) করছেন। তা দেখে তিনিও এগিয়ে যান। পরে দেখেন, আবুল ও হাসান ছেলেটিকে টেনে একটু ভেতরের দিকে নিয়ে যায়। এ সময় মেয়েটি পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং ভয়ে চিৎকারও করতে পারছিলেন না।

কামরুল জবানবন্দিতে আরো বলেন, তারা যখন বুলবুলের কাছে মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ চাই, তখন বুলবুল নিজেকে ভার্সিটির ছাত্র দাবি করে মোবাইল-মানিব্যাগ দিতে অস্বীকার করেন এবং চিৎকার করে আরও ছাত্রদের ঘটনাস্থলে নিয়ে ছিনতাইকারীদের শায়েস্তা করার ভয় দেখান। বুলবুল যখন জোর করছিলেন, কামরুল তখন বুলবুলের পরণের শার্টের সামনের দিকের কলার ধরে পকেটে থাকা ছুরি বের করে তাঁর বুকে প্রথম আঘাত করেন। এসময় বুলবুল নুইয়ে পড়লে পিঠ বরাবর একটি ও ডান হাতের বাহুতে আরেকটি আঘাত করেন।

তিনজনের জবানবন্দি থেকে আরও জানা যায়, বুলবুলকে আঘাতের পর তিনজনই ভয় পেয়ে যান এবং দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। এরপর হাসান ঘটনাস্থল থেকে নিয়ে আসা বুলবুলের মুঠোফোন কামরুলকে দেন। কামরুল সেই মুঠোফোন ও ছিনতাই কাজে ব্যবহৃত ছুরি তাঁর বাসায় বাঁশের চাটাই দিয়ে বানানো ছাদের ওপর রাখেন। পরে গ্রেপ্তার হওয়ার পর কামরুলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পুলিশ ওই জায়গা থেকে মুঠোফোন ও ছুরি উদ্ধার করে।

জবানবন্দিতে মো. আবুল হোসেন জানান, ঘটনার দিন বিকেল চারটার দিকে হাসান ও তিনি গাঁজা সেবন করার জন্য গাজী-কালুর মাজারের টিলায় গিয়েছিলেন। মাজারের পূর্ব দিকে বসে সিগারেটের ভেতর গাঁজা ঢুকাচ্ছিলেন তাঁরা। এ সময় তাঁরা দেখেন, মাজারের পশ্চিম দিকে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে বসে কথা বলছেন। গাঁজা সেবন শেষ হলে হাসান মুঠোফোনে কামরুলকে কল করে বলেন, ‘কামরুল ভাই, টিলা একেবারে নিরালা, ছাত্রছাত্রী আছে, ধান্ধা করা যাইব।’ এরপরই কামরুল ঘটনাস্থলে আসেন।

মো. আবুল হোসেন জবানবন্দিতে বলেন, ‘বুলবুল মোবাইল বা মালামাল দিতে রাজি হয় না। কিন্তু বান্ধবী রাজি হয়ে যায়। বুলবুল মোবাইল না দিয়ে হাসান এবং কামরুলের সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু করেন। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে বুলবুলের পকেট থেকে তাঁর মোবাইল পড়ে যায়, মেয়েটা আনুমানিক ৮-১০ হাত দূরে দাঁড়ানো অবস্থায় ছিনতাইকারীদেরকে বুলবুলকে ছেড়ে দিয়ে মোবাইল ফোন নিয়ে চলে যেতে বলে। কিন্তু বুলবুল মোবাইল দেবে না জানিয়ে হাসান ও কামরুলের সঙ্গে ফের ধস্তাধস্তি শুরু করে।’

জবানবন্দিতে আবুল আরও বলেন, ‘হাসান মাটিতে পড়ে যাওয়া মোবাইলটা নিচ্ছিল, এমন সময় কামরুল তাঁর পকেট থেকে ছুরি বের করে বুলবুলের শার্টের কলারে ধরে তাঁর বুকে, পিঠে, বাহুতে তিনটি আঘাত করে। বুলবুল মাথা ঘুরে যখন মাটিতে পড়ে যায়, হাসান তখন বুলবুলের মোবাইলটি কামরুলের কাছে দেয়। এসময় উর্মি চিৎকার করছিলেন। তখন তারা (ছিনতাইকারীরা) ভয়ে গাজী-কালুর মাজারের পূর্ব দিকে অডিটরিয়ামের পেছন দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়।’

মো. হাসান তাঁর জবানবন্দিতে জানান, কামরুল ঘটনাস্থলে আসার সময় লাকড়ি কাটার লোহার হাতলওয়ালা একটি দা নিয়ে আসেন। সেই দা আবুলের কাছে দেন কামরুল। পরে আবুল ওই দা বুলবুলের গলায় ধরে ভয় দেখিয়ে তাঁকে একটু ভেতরের দিকে নিয়ে যান।

আসামিদের জবানবন্দি ও মামলার সার্বিক তদন্ত বিষয়ে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) উপ-পুলিশ কমিশনার (উত্তর) মো. আজবাহার আলী বলেন- তিন আসামির জবানবন্দির মাধ্যমে বুলবুল হত্যায় কার কী ভূমিকা, সেটি স্পষ্ট হয়েছে। তবে পুরো বিষয়টি এখনো তদন্তাধীন।

উল্লেখ্য, গত ২৫ জুলাই সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাশে গাজী-কালু টিলা লাগোয়া ‘নিউজিল্যান্ড’ এলাকায় বান্ধবী মার্জিয়া উর্মিসহ ঘুরতে গিয়েছিলেন লোকপ্রশাসন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. বুলবুল আহমেদ। এসময় তিনি ছুরিকাহত হন। পরে তাঁকে এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় রাতেই সিলেট জালালাবাদ থানায় হত্যা মামলা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ ইশফাকুল হোসেন।

ঘটনার পর ২৫ ও ২৬ জুলাই তিন ছিনতাইকারীকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করে। তাঁদের মধ্যে আবুল হোসেনের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে ২৭ জুলাই কামরুল ও হাসানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

ঘটনার পরদিন (মঙ্গলবার) দুপুরে সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে প্রথম এবং নরসিংদীর নন্দীপাড়া গ্রামে বুলবুলের বাড়ির সামনে তার দ্বিতীয় জানাজা হয়। ওই দিন রাত সাড়ে নয়টার দিকে নরসিংদীর মাধবদীর কাঁঠালিয়া ইউনিয়নের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় জানাজা শেষে নিকটস্থ কবরস্থানে বাবার পাশে তাকে নিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।

এদিকে, রোববার বুলবুলের মা, ভাই, দুই বোনসহ পরিবারের সদস্যরা শাবিপ্রবিতে এসে বুলবুলের ব্যবহৃত জিনিস নিয়ে যান।






Related News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *